হােমিওপ্যাথি ও বায়োকেমিকে পথ্যাপথ্য

চিকিৎসা করতে এসে রুগীরা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন ডাক্তারবাবু কি খাব । আর কি খাব না। বিশেষ করে তারা জেনেই আসেন হিং, কপূর, পেঁয়াজ ও তেঁতুলের টক হােমিওপ্যাথি চিকিৎসা করলে খেতে নেই। অনেকে আবার এই ভয়ে চিকিৎসা করতে চান না।

আসল সত্য ঘটনা কি?

যে কোন প্রকার রুগীর চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসকের পক্ষে রােগীর পথ্যাপথ্যের একটা সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করা অসম্ভব কাজ, কারণ এক এক রােগীর জন্য এক এক রকমের পথ্যের বা খাবারের প্রয়ােজন হয়। বিশেষ বিশেষ রােগীর জন্য বিশেষ বিশেষ খাদ্যের প্রয়ােজন। তবে নিম্নলিখিত নীতিগুলাে পথ্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই মেনে চলা উচিত, কারণ হজম শক্তি ভাল হলে শরীর ভাল থাকে, ওজন বাড়ে, কর্ম উদ্দীপনা বাড়ে এবং সবল ও সতেজ স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায়। তাই যখনই কোন রােগীকে হােমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়ােগ করা হয় তখনই তার পথ্যের দিকে দৃষ্টি রাখা উচিত। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যারা নিরামিষাশী তাদের ক্ষেত্রে হােমিওপ্যাথিক ওষুধ অধিকতর ক্রিয়াশীল কিন্তু যারা মাংসাশী তাদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ক্রিয়াশীল। আরাে একটি উল্লেখযােগ্য বিষয় হচ্ছে যে হােমিওপ্যাথিক ওষুধ সেবনকালীন অথবা এই পদ্ধতিতে যদি রােগীর চিকিৎসা করা হয় তবে উগ্র জাতীয় যে কোন পদার্থ যেমন—মদ, তামাক, সিগারেট ইত্যাদির অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

পথ্য খাবার নির্বাচন ক্ষেত্রে আমাদের কি লক্ষ্য রাখতে হবে?

পথ্য খাবার নির্বাচন ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, যেমন ১) ওষুধের ক্রিয়া নষ্ট হয় বা ব্যাহত হয় এমন কোন পথ্য খাবার যেন রােগী না খান। ২) রােগী যে রােগে ভুগছে সেই রােগের পক্ষে ক্ষতিকর এমন কিছু যেন না খান।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে পিয়াজ থুজার প্রতিরােধক (anti) কাজেই কোন রােগীকে থুজা দিলে তাকে অবশ্যই পিয়াজ খেতে নিষিদ্ধ করা উচিত। হােমিও শাস্ত্রমতে এইরকম প্রত্যেক ওষুধের যে প্রতিরােধক তালিকা আছে । খাদ্য তালিকা থেকে সে সব খাবার বাদ দেওয়া উচিত। কফি, কপূর, হিং, তেঁতুল প্রভৃতি দ্রব্যে ওষুধজ গুন বর্তমান থাকায় চিকিৎসা চলাকালীন রােগীর পক্ষে গ্রহণ না করা ভাল। সঠিক পথ্য নির্বাচন যে আরােগ্য লাভের পথে সহায়ক তা প্রত্যেক চিকিৎসকেরই উপলব্ধি করা উচিত।

তরুণ রােগে [in Acute Cases]

অর্গাননে ডাঃ হ্যানিম্যান উল্লেখ করেছেন যে, তরুণ রােগে পথ্য সম্পর্কে তেমন কড়াকড়ি করার প্রয়ােজন নেই। রোগী যা খেতে চায় বা যেভাবে থাকতে চায় তাকে তা করতে দেওয়া উচিত। কারণ তরুণ রােগের রােগী তার পক্ষে ক্ষতিকর কোন খাদ্য খেতে চায় না বরং যেসব খাদ্যের প্রতি তার একটা তীব্র অনিচ্ছা ভাব দেখা যায়। কারণ তরুণ, রােগের আকস্মিকতা, ভয়াবহতা এবং উত্তেজক কারণ বর্তমান থাকা। তরুণ রােগ হঠাৎ আক্রমণ করে এবং ভীষণভাবে তার লক্ষণ প্রকাশ করে। জীবনশক্তি সেখানে পুরাতন রােগের তুলনায় সতেজ থাকে। কাজেই উত্তেজক কারণের সহায়ক এবং জীবনী শক্তি দুর্বল করার পথে সাহায্যকারী এমন কোন খাদ্য স্বাভাবিক কারণেই রােগী খেতে চাইবে না। তবুও যদি খেতে চায় তবে সেই খাদ্য খেতে দিলে এমন  প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে যা রােগী এবং চিকিৎসক উভয়ই বুঝতে পারবেন যে উক্ত খাদ্য তার পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক।

তরুণ রােগে কি ব্যবহার করবেন না।

১) গন্ধদ্রব্য, যেমন—সেন্ট, স্নাে, সুবাসিত জল, গােলাপ জল, দাঁতের গন্ধযুক্ত মাজন এইগুলাে চিকিৎসাকালীন ব্যবহার না করাই ভাল। যে কোন গন্ধ দ্রব্যের ক্রিয়া স্নায়ুর উপর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যদিও এই ক্রিয়া ক্ষণস্থায়ী তবুও তা ওষুধের ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে বা বিঘ্ন ঘটায়। তাই ভিনিগার, টক জাতীয় দ্রব্য, টক ফল, চা, নস্যি, কফি ইত্যাদির ব্যবহার না করাই ভাল। |
২) যে সকল রােগীর ধাতু দৌবল্য আছে তাদেরকে মুরগী, ডিম, মশলা দেওয়া খাবার বেশী খেতে দেওয়া উচিত নয়।

৩) মাসিক ঋতুস্রাব খুব বেশী এমন স্ত্রীলােকদের লবঙ্গ, দারুচিনি, মুষ্কিপাতি তেজপাতা খেতে দেওয়া উচিত নয়।

৪) হজমের গােলমাল আছে এমন রােগীকে মশলা, লবঙ্গ, দারুচিনি, লংকা, তিতো ইত্যাদি খেতে দেওয়া উচিত নয়। যে সব শাক সব্জিতে পেটে গ্যাস জন্মে তা না খাওয়াই উচিত। ধুমপান বর্জন করা কর্তব্য। |
৫) একটি কথা সর্বদাই মনে রাখতে হবে যে হােমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সুক্ষ্ম মাত্রায় প্রয়ােজনীয়তা এবং উপযােগিতার কথা বিবেচনা করলেই আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, চিকিৎসাকালে কোন ওষুধ গুণ সম্পন্ন পথ্য গ্রহণ করতে দেওয়া উচিত নয়, কারণ হােমিওপ্যাথিক ওষুধের ক্রিয়া ও পথ্যের প্রতিক্রিয়ায় ওষুধ বিনষ্ট বা বাধা পেতে পারে।
এছাড়া-~
ক) অতিরিক্ত চিনি এবং লবণের ব্যবহার,
খ) মদ বা অন্যান্য পানীয় পান করা,
গ) গরম ঘর,
ঘ) গায়ের চামড়ার ঠিক উপরে পশমের বস্ত্র পরিধান, ঙ) আবদ্ধ কামরায় অলস জীবন যাপন,
চ) অধিক সময় ধরে ব্যায়াম, যেমন—ঘােড়ায় চড়া, গাড়ী চালনা, দোলনা চড়া,
ছ) দীর্ঘ সময় ধরে স্তন্য পান  করানো,
জ) বিছানায় অর্ধশায়িত অবস্থায় দীর্ঘকাল দিবা নিদ্রা, ঝ) অধিক রাত্র জাগরণ,
ঞ) অপরিচ্ছন্নতা,
ট) অস্বাভাবিক লাম্পট্য,
ঠ) অশ্লীল বই পড়ে স্নায়বিক অবসাদ বা শায়িত অবস্থায় বই পড়া প্রভৃতি ,রােগীকে পরিহার করতে হবে,
ড) হস্তমৈথুন অথবা অসম্পূর্ণ বা অপ্রতিহত রতিক্রিয়া, ঢ) ক্রোধ, দুঃখ বিরক্তকর বিষয় বা খেলার জন্য ভাবাবেগ,
ণ) খাবার পরে মানসিক ও শারীরিক (অতিরিক্ত) পরিশ্রম,
ত) জলাভূমিতে বা স্যাত সেঁতে ঘরে বাস ও দারিদ্রক্লিষ্ট জীবন যাপন ইত্যাদি বিষয়গুলির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ইহা আরােগ্য পথে বাধার সৃষ্টি করে। | তবে যাতে আরােগ্য সাধন বাধাপ্রাপ্ত বা দুঃসাধ্য হয়ে পড়তে না পারে সেজন্য এই সব বিষয় রােগীকে যতদূর সম্ভব বর্জন বা অপসারণ করতে হবে।

তবে কোন কোন চিকিৎসক বিনা প্রয়োজনে রােগীর মোটামুটি সহ্য হয় এমন খাদ্য ও পানীয়ও বাদ দিয়ে রোগীর অসুবিধা সৃষ্টি করেন। ইহা কখনই সমর্থন যােগ্য নয় ? ব্রংকাইটিস, হজমশক্তির অভাব, ‘আমাশয়, বাত, ব্রাইটস ডিজিজিস, বহুমুত্র, উপদংশ, ক্যানসার ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত রােগীদের জন্য যথাযথ পথ্যের ব্যবস্থা করা উচিত, নতুবা আরোগ্য লাভ সহজে হবে না বরং অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়।

হিং, কপূর, পিঁয়াজ, রসুন ও ধূপ-ধোয়ার গন্ধে কি হােমিওপ্যাথি ওষুধ নষ্ট হয়?

কেউ বলেন না ওষুধের গুণ নষ্ট হয় না, কেউ বলেন হা ওষুধের গুণ নষ্ট হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি কি?

হােমিওপ্যাথিক ওষুধের স্বল্প মাত্রার দ্বারা অসংখ্য কঠিনরােগ প্রতিদিন আরােগ্য হচ্ছে, এবং উহা সত্য ন্যায় ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাশাস্ত্র। কিন্তু এমন কতকগুলি কথা এই চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিতরে প্রবেশ করেছে যার ফলে লােকে কেবল ঐ কথাগুলির জন্য হােমিওপ্যাথিকশাস্ত্রকে উপহাস করেন। তাই বর্তমানে ঐগুলি বিচার করে দেখার প্রয়ােজন।

তরুণ রােগ বা অ্যাকুট ডিজিজ (Acute disease) চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাধানিষেধ কেবল পথ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর তাছাড়া অজপাড়াগাঁয়ের যেখানে ডাক্তার পাওয়া যায়না সেখানেও অ্যাকুট রােগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতি পরিবারের মায়েরাই প্রথমে পথ্যাপথ্যের প্রতি সর্তকতা অবলম্বন করেন, তখন তারা বিচার করেন না পরে হােমিওপ্যাথি চিকিৎসা হবে না অন্য কোন শাস্ত্রমতে চিকিৎসা হবে। যেমন, কলেরা রােগীকে কেউই মাছ, মাংস, ডিম খেতে দেননা, আবার টাইফয়েড বা নিউমোনিয়ারােগীর ক্ষেত্রেও কেবল পথ্যের উপরই বিশেষ জোর দেন। অনুরূপভাবে চিকিৎসকগণ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথমেই জোর দেন সঠিক পথ্য নির্ধারণের উপর। অতএব পথ্যের দ্বারা ওষুধের ক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায় এরূপ কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। তবে যে খাদ্য দ্বারা রােগীর রােগের বৃদ্ধি হয় তা কুপথ্য, আর কুপথ্য সম্বন্ধে সর্তকতা অবলম্বন করাই কর্তব্য। তাই অ্যাকুট রােগে কেউই হিং, পেঁয়াজ, রসুন প্রভৃতি মশলাদি খাদ্য খান না বা চিকিৎসকগণ ব্যবহার করার উপদেশ দেন না ।

ক্রনিক রােগ (Chronic disease)

ক্রনিক রােগ (Chronic disease) চিকিৎসা করার সময় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকগণ কয়েকটি জিনিস ভাল করে চিন্তা করে দেখতে হয়। অনেকেই বলেন হানিম্যান তার ক্রনিক “ডিজিজ চিকিৎসা” গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ১১২ পাতায় এবং কেন্ট তাঁর “লেকচার অন হােমিওপ্যাথিক ফিলজফি” নামক গ্রন্থের ২৭১-২৭২ পাতায় নানারকম বিধিনিষেধের সম্বন্ধে বলে গেছেন অতএব সেগুলি হােমিওপ্যাথদের মেনে চলাই একান্ত কর্তব্য। কিন্তু প্রত্যেকের ভেবে দেখা উচিত প্রকৃতপক্ষে তারা কি বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তারা যা বলতে চেয়েছিলেন তা না বুঝে গােড়ামির দ্বারা চালিত হয়ে বিভিন্ন চিকিৎসক তাঁদের (হ্যানিম্যান ও কেন্টের) কথাগুলির ভুল ব্যাখ্যা করেন ও করেছেন যার ফলে সাধারণের মনে বিভিন্ন রূপ বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।

ধূপ ও ধোঁয়ার গন্ধে কি ঔষধ নষ্ট হয়?

কলিকাতায় হাজার হাজার লরি, বাস, ট্যাক্সি চলাচল করে এবং ঐ গাড়িগুলি থেকে প্রতিদিন রাশিরাশি ধোঁয়া আর পেট্রোল ও ডিজেলের গন্ধ চারিদিক ছড়িয়ে পড়ছে। তার ফলে নিশ্চয়ই কলকাতার হােমিওপ্যাথি ওষুধ দোকানের ওষুধগুলিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথবা ধরুন মহেশ ভট্টাচার্য, হ্যানিম্যান পাবলিশিং ও কিং প্রভৃতি কোম্পানির কর্মচারীগণ যখন ওষুধ তৈরী করছেন তখন কতকগুলি গাড়ী ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দোকানের সামনে দিয়ে চলে গেল ফলে রাশি রাশি পেট্রোলের ধোঁয়া ঢুকে দোকানে সব ওষুধই নষ্ট হয়ে গেছে, আর ব্যবহার করা যাবে না তাই কি? বেশ ভাল করে দেখুন ধোয়ার গন্ধে লক্ষ লক্ষ ফাইল ওষুধ নষ্ট হয় না বা তারা ওষুধগুলিকে ফেলে দেন না। কিন্তু যে মুহূর্তে ওষুধগুলি হােমিপ্যাথিক ডাক্তারের ডাক্তারখানার বাক্সে রাখা অমনি বলা হল ধূপ ও ধোয়ার গন্ধে ওষুধ নষ্ট হয়ে যায় সুতরাং ধুমপান নিষেধ, ধূপ দেওয়া বা ধুননা দেওয়া নিষেধ তা ঠিক কি? আবার হ্যানিম্যান তার “ক্রনিক ডিজিজ” চিকিৎসা নামক গ্রন্থের ১ম খন্ডের ১৩৯ পাতায় পিয়াজ, রসুন ও হিং খাওয়া সম্বন্ধে যা নির্দেশ দিয়েছেন তা বিচার করে দেখলে, কি দেখা যায় তা দেখা যাক। ধরা যাক একজন রােগী আফিং খান, তিনি হােমিওপাখি চিকিৎসা করতে এসেছেন এখন যদি হােমিওপাথি ডাক্তারবাবু বলেন আপনি আফিং খাওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে তবে চিকিৎসা করাতে আসবেন, তাহলে কি ঘটবে । ভেবে দেখেছেন কি?

রােগের যে যন্ত্রণা তার চেয়ে শতগুণ যন্ত্রণা বৃদ্ধি পাবে আফিং বন্ধ করার জন্য। আর এর ফলে রােগও আরােগ্য হবে না, উপরন্ত অভ্যাস ত্যাগের জন্য তার নানাবিধ উপসর্গের সৃষ্টি হবে; অতএব এক্ষেত্রে উচিত ক্রমে ক্রমে রােগীদের যদি কোন অভ্যাস থাকে তা পরিত্যাগ করার উপদেশ দেওয়া, একেবারে বন্ধ করে চিকিৎসা করা নয়। অনুরূভাবে পান, দোক্তা, চা, গাঁজা, মদ্যপান, ধূমপান বা অ্যালােপ্যাথি ওষুধ ব্যবহার করা প্রভৃতি ব্যাপারগুলি বিবেচ্য।

ধূমপান ও মদ্যপান

হানিম্যান ধূমপান ও মদ্যপান সম্পর্কে সংযত (limited) হওয়ার কথা বলেছেন।তিনি ধূমপান ও মদ্যপান নিষেধ করেননি। তিনি বলেছেন “Smoking in cases of chronic diseases may be permited” (ক্রনিক ডিজিজ চিকিৎসার ১১৪ পৃৎ ১ম খন্ড)। নিষেধ করলে তিনি ওখানে “limited and perimited” না লিখে নিশ্চয়ই “prohibited” কথাটি লিখতেন। তবে যারা বেশী ধূমপান বা মদ্যপান করেন তাদের অবস্থা কিরকম হয় তা আমরা সবাই জানি। এখন যদি হ্যানিম্যান ধূমপান ও মদ্যপানে সংযত হতে বলেছেন বলে হােমিওপ্যাথি চিকিৎসকগণ বলতে শুরু করেন দেশবাসীগণ আপনারা যখন হােমিওপ্যাথি ওষুধ সেবন করতে আসবেন তখন জন্মের মত ধূমপান বা মদ্যপান বন্ধ করে তবে আসবেন; তাহলে কি ঘটবে চিন্তা করে দেখেছেন কি? আর এটি সম্পূর্ণ অবান্তর কথা নয়কি? . কারণ আমরা সবাই জানি অভ্যাস মানুষের দ্বিতীয় প্রকৃতি (Habit is the Second nature of Man)। আর যার যা অভ্যাস তা রাতারাতি বদলানো যায়না। কেউ যদি জাের করে অভ্যাস বদলানাের চেষ্টা করেন তবে তা উপকার অপেক্ষা অপকারই বেশী হয়। হ্যানিম্যান ক্রনিক ডিজিজ চিকিৎসায় ১ম খন্ডের ১১২ পাতায় ও ফুটনােটে বলেছেন ধীরে ধীরে অভ্যাস বদলাতে হবে। আর শুধু হােমিওপ্যাথ কেন অন্য যেকোন প্যাথই ঐগুলি ধীরে ধীরে কমাতে উপদেশ দেবেন। বিশেষ করে এটিই বলা উচিত আপনি ওষুধ সেবনের এক ঘন্টা আগে ও একঘন্টা পরে আপনার নেশার দ্রব্য, পান বা আহার করবেন।

হিং, কপূর, পিঁয়াজ ও রসুন :

হিং, কপূর, পিঁয়াজ ও রসুন থেকে হােমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরী হয়, সুতরাং কিভাবে হােমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকালে ঐগুলি ব্যবহার করা চলে?

হিং, পিয়াজ, রসুন থেকে হােমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরী হয় কিন্তু এমন কোন খাদ্য দ্রব্য আছে কি?

যার মধ্যে ওষুধের গুণ বর্তমান নেই। যেমন ধরা যাক লবণ ও জল। লবণ না হলে কোন খাদ্যই আহারের উপযুক্ত হয়না। কিন্তু লবণ থেকে যে ওষুধটি তৈরী হয় সেটি হােমিওপ্যাথিক বায়োকেমিক জগতের অন্যতম শ্রেষ্ট ওষুধ নেট্রাম মিউর, হ্যানিম্যানের শ্রেষ্ঠ অবদান। অতএব লবণ থেকে নেট্রাম মিউর যখন তৈরী হয় তখন লবণ বর্জনীয় নয়কি?জলের ব্যাপারও তদরূপ, কলকাতা শহরের যে পানীয় জল আমরা পান করি তা ফিটকারী দিয়ে পরিস্কার করে তার পর ক্লোরিন দিয়ে শোধন করা হয়। এখন যদি হােমিওপ্যাথি চিকিৎসকগণ ফতোয়াজারী করেন যে হােমিওপ্যাথিক ওষুধ সেবন করতে হলে তাদের কলের জল পান করা বন্ধ করতে হবে, তাহলে কি হবে? আবার পল্লী অঞ্চলের মানুষ কূপ, নলকূপ, ঝরনা ও পুকুরাদির জল পানে অভ্যস্থ, আর ঐ সকল জলের মধ্যে ক্যালসিয়াম, সােডিয়াম, ফেরাম প্রভৃতি রাসায়নিক দ্রব্য থাকে ফলে রােগীরা ঐ জল পান করতে পারবে না অথবা বালিতে মুড়ি বা চালভাজা ভাজা হয়, আর প্রায়ই মুড়ির সঙ্গে বালি মিশে থাকে; অতএব মুড়ি বা চালভাজা খাওয়া বন্ধ করা যায় কি? যায় না, কারণ জল পান করে বা মুড়ি খেয়ে কোন ওষুধের ক্রিয়া দেখা যায় না, কিন্তু বালি থেকেই তৈরী হয় একটি শক্তিশালী হােমিওপ্যাথি বায়োকেমিক ওষুধ সাইলিসিয়া।অতএব এইসব বিচার করে দেখা যাচ্ছে হিং, পিয়াজ, রসুনই বলুন বা জল, লবণই হােক; খাদ্য ও পানীয়ের সাথে ওষুধের ক্রুড পদার্থ সেবনে শরীরের বিশেষ পরিবর্তন হয়না। যখন এদের শক্তিকৃত করা হয় তখনই ওষুধরূপে কাজ করবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। তবে যদি বেশী মাত্রায় রােগীকে হিং, পিঁয়াজ, রসুন প্রভৃতি খেতে দেওয়া হয় তবে তার উপসর্গ বৃদ্ধি পাবে, এমনকি সুস্থ সবল ব্যক্তিকেও যদি কমলালেবু বা বেদানা বেশী খেতে দেওয়া হয় তাহলেও উপসর্গের হাত থেকে সে রেহাই পাবে না। অতএব এখানে মাত্রাধিক্য ও নিয়মের কথাই উঠে। অভ্যাস যা আছে তা একেবারে বর্জনকর এ নীতি কোন সুধী ব্যক্তির মনে স্থান পেতে পারে না। তাছাড়া ইউরােপ ও আমেরিকায় হিং, পিঁয়াজ, রসুন প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে খায় সেতুলনায় আমাদের দেশে কমই দেখা যায়, এমনকি কোন কোন অঞ্চলে ঐগুলি নিষিদ্ধ খাদ্য। অতএব ঐ দেশের আহার-বিহার ও চলাফেরার সাথে আমাদের দেশের কিছুই তুলনা চলে না। তাছাড়া ঐ দেশের মাত্রাধিক্য ব্যবহারের ফলে উৎপন্ন উপসর্গকে এড়াতেই হ্যানিম্যান বিভিন্ন পথ্যাপথ্যের উপর বিভিন্ন প্রকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়া হোমিওপ্যাথিতে বিশেষ কয়েকটি ওষুধ আছে যেগুলির সঙ্গে হিং, পিয়াজ,রসুন ব্যাবহারের ফলে নতুন নতুন উপসর্গ দেখা যায়। সুতরাং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকগণের উচিত সেগুলি বিশেষ মনের বিচার করে তবে রােগীদের নির্দেশ দেওয়া। তা না করে যদি একই ফরমুলা অনুসারে বলা হয় হিং, পিয়াজ, রসুন খেলে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেওয়া চলবে না যা হােমিওপ্যাথি ওষুধ খেলে এগুলি খাবেন না তা কোনমতেই ঠিক নয়। কারণ আমরা সবাই জানি হ্যানিম্যান প্রচুর মাত্রায় সিগার পানে অভ্যাস্থ ছিলেন। তিনি অনবরতই ধুমপান করতেন এবং সেই অবস্থাতেই তিনি হোমিওপ্যাথি ওষুধের প্রুভিং করেছেন। তাই পথ্যাপথ্যের ব্যাপারে সবাই একবার ভেবে নেবেন। তারপর রােগীকে বলবেন কি খাবেন, কি খাবেন না।

ডাঃ রাজা সেখ (মুহাম্মদ রাযা কাদেরী)

Dr. Raja Sk ( Muhammad Raza Qadri)